মেহেরুল ইসলাম মোহন নাটোর
আজ ১৩ই ডিসেম্বর, নাটোরের লালপুরের ইতিহাসে আজ হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পরাজিত পাক হানাদার বাহিনী লালপুর থেকে বিতাড়িত হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজশাহীর ২৫ নম্বর পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন কর্ণেল বালুচ এবং টুওয়াইসি মেজর রাজা আসলামের নেতৃত্বে পাকবাহিনীর বর্বরতায় শহীদ হন লালপুরের এম এন এ নাজমুল হক সরকার, অবাঙ্গালী হাফিজ সাত্তার, বীরেন সরকার উকিল, শিল্প ব্যাংকের ম্যানেজার সাইদুর রহমানসহ আরও অনেক সাধারণ জনগণ।
২৭ মার্চ ওমর ফারুক সরকার, ডাঃ খলিলুর রহমান, চেয়ারম্যান হাজির উদ্দীন সরকার, ডাঃ আবুল কাশেম (কর্নেল অবঃ), বাবু বলাই চন্দ্র সাহাসহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের এক জরুরী বৈঠকে প্রাক্তন সৈনিক ও আনছারদের নিয়ে লালপুরে একটি প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করা হয়। মসলেম দফাদার, হামিদুল হক (পোড়াবাবু), ওয়াহেদ, আজিত, রামচন্দ্র, আঃ সাত্তার লেড়–, মাহ্বুবুর রহমান সেন্টু সহ ১৬ জনের এই বাহিনী কিছু দিনের মধ্যেই ৩০ জনে উন্নীত হয়। লালপুর থানা, নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল ও সরদহ পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার (পিটিসি) থেকে প্রাপ্ত কয়েকটি (থ্রি নট থ্রি) রাইফেল, দেশী বন্দুক ও তীর-ধনুকে সুসজ্জিত এই বাহিনীর অস্থায়ী অফিস ক্লাব ভবনে স্থাপন করা হয়।
কয়েকজন আনসার কমান্ডারের নেতৃত্বে স্থানীয় জনতার সহায়তায় এই প্রতিরক্ষা বাহিনী ২৮ মার্চ ঈশ্বরদী বিমান ঘাটি দখল করেন। বিমান বন্দরের রানওয়ের উপর বুল ড্রেজার রেখে, খালখন্দ কেটে প্রতিরোধ সৃষ্টি করা হয়।
৩০ মার্চ ময়নায় সম্মূখ যুদ্ধে মুক্তি সেনারা হানাদারদের ২৫ নং রেজিমেন্ট ধ্বংস করে দেয়। সেদিন প্রায় ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৩২ জন আহত হন। ঐদিনই পাক সেনাদের ছোড়া একটি সেলে চামটিয়া গ্রামে ৩ জন শহীদ হন।
১২ এপ্রিল ধানাইদহ ব্রিজের নিকট প্রতিরোধ যুদ্ধে ১০/১২ জন শহীদ হন।
নাটোর জেলার যে কয়েকটি স্থানে পাক হানাদাররা নৃশংস হত্যা চালায় তার মধ্যে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের গণহত্যা ছিল সবচেয়ে নির্মম ও হৃদয় বিদারক। সুগার মিলের প্রশাসক লেঃ আনোয়ারুল আজিম ছিলেন একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। এ বিষয়টি পাক মিলিটারিরা জানতে পারলে তিনি তাদের রোষানলে পড়েন। পাক মেজর শেরওয়ানী তাকে নাটোরের হেড কোয়ার্টারে ডেকে কঠোর ভাবে শাসিয়ে সুগার মিল চালু রাখার নির্দেশ দেয়। এ নির্দেশের বিপরীতে আনোয়ারুল আজিম অকুতোভয় চিত্তে মেজরকে শর্ত আরোপ করে বলেন তার এলাকায় নিপীড়ন- অত্যাচার বন্ধ করা হলে সুগার মিল চালু থাকবে।
মেজর শেরওয়ারী শর্ত আরোপে অবাক হয়ে পরে কথা দেয় যে অত্যাচার, নিপীড়ন করা হবে না। কিন্তু পাক সেনারা সে কথা রাখেনি। ৫ই মে পাকবাহিনী ও রাজাকার সম্মিলিত ভাবে সমস্ত সুগার মিল এলাকা ঘেরাও করে এবং সেখানে কর্মরত প্রায় দু’শ শ্রমিক, কর্মচারি ও কর্মকর্তাকে সুগার মিল চত্বরের পুকুর পাড়ে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে।
ঐ দিনই গোপালপুর বাজারে ৭ জনকে হত্যা করে এবং গোপালপুর-লালপুর রাস্তার আরও ৫ জন টমটম আরোহীকে গুলি করে হত্যা করে। স্বাধীনতার পরে এই পুকুরের নাম দেওয়া হয়েছে ‘শহীদ সাগর’। শহীদ আনোয়ারুল আজিমের নামে গোপালপুর রেল স্টেশনের নাম রাখা হয়েছে ‘আজিম নগর’ স্টেশন।
২৯ মে খান সেনাদের একটি দল চংধুপইলের পয়তারপাড়া গ্রামে নদীর পাড়ে ধরে এনে ৫০ জনেরও অধিক নিরীহ লোকজনকে গুলি করে হত্যা করে।
১৮ জুলাই গোপালপুর থেকে ধরে এনে ২২ জনকে লালপুর নীলকুঠির নিকটে হত্যা করা হয় এবং ১৯ জুলাই একই স্থানে ৪ জনকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়। ২০ জুলাই রামকৃষ্ণপুর গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও ৫ জনকে হত্যা করে। ২৭ জুলাই বিলমাড়িয়া হাট ঘেরাও করে বেপরোয়া গুলি বর্ষণ করে ৫০ জনেরও অধিক লোককে হত্যা করে।
৮ ডিসেম্বর পাঞ্জাব পুলিশ ও খানসেনারা থানা ত্যাগ করে। ৯ ডিসেম্বর অধিকাংশ রাজাকারও থানা ত্যাগ করে। ১০ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী থানা দখল করে । জনতা সেদিন উল্লাসে ফেটে পড়েন। কিন্তু এর পরেও একটি বড় আঘাত অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ
১৩ ডিসেম্বর বর্বর খান সেনারা ঝটিকা আক্রমণ করে মহেশপুর গ্রামে ৩৬ জনকে গুলি করে পালিয়ে যায়।
১৪ ডিসেম্বর ভেড়ামারা ও পাকশীতে সারাদিন ধরে বিমান যুদ্ধ ও বিমান বিধ্বংসী কামানের শব্দে আশপাশের এলাকা প্রকম্পিত হয়ে উঠে। পাকশি হার্ডিঞ্জ ব্রিজটি ঐ দিনই বিকট শব্দে ভেঙ্গে পড়ে।
২১ ডিসেম্বর নাটোরে মিত্রবাহিনী ও মুক্তি বাহিনীর যৌথ কমান্ডের নিকট খান সেনারা আত্মসমর্পণ করে। চারিদিকে জয়বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে।
২৫ মার্চ থেকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাক বাহিনী ও দেশীয় দালাল ও রাজাকারদের সহায়তায় লালপুরের বিভিন্ন এলাকায় হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিকান্ড ও লুটতরাজ চালায়। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়।
আপনার মতামত লিখুন :