[gtranslate]

কবি জাসমিনা খাতুনের কবিতায় ডঃ শিবাশিস মুখার্জির দীপ্ত দৃষ্টির প্রতিফলন


প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৫, ১০:৪৩ পূর্বাহ্ন / ৩৪২
কবি জাসমিনা খাতুনের কবিতায় ডঃ শিবাশিস মুখার্জির দীপ্ত দৃষ্টির প্রতিফলন

অক্ষরনিমজ্জন : জাসমিনা খাতুনের কবিতায় বিস্মৃতি ও নিমজ্জনের ভাষা

প্রিয় কবি জাসমিনা খাতুনের ‘অক্ষরনিমজ্জন’ কবিতাটি সমকালীন বাংলা কবিতার ভুবনে এক অনন্যসাধারণ ধ্বনি তোলে। কবিতার কেন্দ্রে রয়েছে অক্ষর ও ভাষা—কিন্তু তা আর স্থির বা দৃশ্যমান নয়; বরং প্রবাহমান, নিমজ্জিত, এবং দূরত্বে বিলীন।

কবিতার সূচনায়—

“প্রচ্ছদে জমেছে বিস্মরণের হিমপ্রবাহ”

এই চিত্রকল্প পাঠককে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যায় এক স্তব্ধ, জমাট সময়ের অভ্যন্তরে। ‘প্রচ্ছদ’ এখানে কেবল বইয়ের বাইরের খোলস নয়, বরং জীবনের উপরে জমে থাকা অবসাদ ও বিস্মৃতির প্রতীক।

কবি, যেন সাহিত্যকে ব্যবহার করে নিজের মনের গোপন দীর্ঘশ্বাস গুঁজে দেন পাতার ফাঁকে—একজন লেখকের নিঃশব্দ আর্তি সেই লাইনে মুখর হয়ে ওঠে।এরপর কবিতায় ভাষার ভাঙচুর ও পুনর্গঠনের ইঙ্গিত দেখা যায়। শব্দ নেমে আসে ছাদের চৌকাঠ ভেদ করে—

“হৃদয়দেয়ালে লেপ্টে থাকা কাদা-শ্যাওলার ব্যাকরণে”

এই লাইনটিতে ভাষার শরীর যেন নোংরা ও ক্ষয়িষ্ণু; অথচ এই পচনের ভেতরেই জন্ম নেয় এক নতুন কাব্যধারার।

মধ্যভাগে এসে—

“বিপর্যয় ভাসিয়ে নিয়ে যায় সহস্র অক্ষর”—

এই পঙ্‌ক্তিটি কেবল ব্যক্তিগত যন্ত্রণার প্রকাশ নয়; বরং বৃহত্তর সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের প্রতীকও বটে। অক্ষরের মৃত্যু মানেই কবিতার অবসান নয়—বরং সেই অন্ধকারেই জেগে ওঠে এক জলজ অনুভব, এক নবজন্ম। শহরের প্রতিটি কোণ ছেয়ে যায় সেই মগ্ন উচ্চারণে—এ যেন কবিতার মাধ্যমে সমষ্টিগত চেতনার উন্মোচন।

শেষ অংশে এসে কবি অক্ষরকেও দূরে সরিয়ে দেন—

“শিরোনামের অক্ষরগুলিও অনন্ত দূরত্বে”—

এই উপলব্ধি কবিতার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক। কবিতা যতই কাছে টানে, তার আসল স্পর্শ অধরাই থেকে যায়। এখানে জাসমিনা খাতুন সেই আধুনিক কবিস্বরকে ধারণ করেন, যা কখনো শঙ্খ ঘোষের নীরবতার দোলাচলের মতো, আবার কখনো জয় গোস্বামীর অন্ধকার-সন্নিকট চিত্রভাষার মতো অনুভূত হয়।

তবে এই মিল থাকা সত্ত্বেও কবিতাটি সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব। জাসমিনার কণ্ঠস্বর ভাষা, জল, বিস্মৃতি ও দূরত্বের মেলবন্ধনে এক স্বতন্ত্র কবিত্ব নির্মাণ করে।

অতএব, ‘অক্ষরনিমজ্জন’ কেবল একটি কবিতা নয়—এ এক ভাষার ভেতর দিয়ে অনুভবের নিমজ্জন। পাঠক যখন এই কবিতা পাঠ করেন, তখন তিনিও ভিজে যান সেই বিস্মৃতির স্রোতে, আর অনুভব করেন এক অদৃশ্য অথচ গভীর স্পর্শ।

ব্যক্তিগত মূল্যায়ন: কবি জাসমিনা খাতুনকে যেভাবে আমি দেখেছি

আমার প্রিয় কবি জাসমিনা খাতুনকে আমি প্রথম পরিচয় পাই ২০২২ সালে, প্রয়াত সাহিত্যকর্মী সোমনাথ নাগ-এর একটি অনুষ্ঠানে। ক্ষণিকের সেই পরিচয় কেবল সামাজিক ছিল, কিন্তু তাঁর লেখা পড়ে মনে হয়েছে—তিনি মূলত শব্দের ভেতর লুকিয়ে থাকা নীরবতাকেই খুঁজে ফেরেন।

তিনি লেখেন যেন নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো স্বাভাবিক ছন্দে, অথচ প্রতিটি পঙ্‌ক্তি পাঠকের হৃদয়ে তীব্র কম্পন তোলে। তাঁর কবিতায় জল, অন্ধকার, বিস্মৃতি ও বেদনা প্রতিনিয়ত প্রবাহিত—তবে সেগুলি কেবল ব্যক্তিগত নয়; বরং ভাষার আলোয় গঠিত এক গভীর, সর্বজনীন যন্ত্রণার ভাষ্য।

আমার চোখে জাসমিনা খাতুন সেই বিরল কবি, যিনি কোনো বাহ্যিক প্রশংসার জন্য নন, বরং হৃদয়ের গভীরতম নিঃশব্দতাকে ভাষায় রূপ দিতে লেখেন। তাঁর কবিতা পড়ে মনে হয়—তিনি অনেক কিছু হারিয়েছেন, অনেক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন, এবং সেই ক্ষয় থেকে গড়ে তুলেছেন শব্দের এক অনুপম প্রাসাদ।

তিনি একদিকে ভীষণ সংবেদনশীল, অন্যদিকে প্রবল শক্তিধর। তাঁর শব্দচয়ন কখনো নদীর মতো শান্ত, কখনো ঝড়ের মতো উন্মত্ত। এই দ্বৈততাই তাঁকে আলাদা করে তোলে। তাঁর কবিতা কোনো সস্তা আবেগের অনুকরণ নয়; বরং এক আত্মমগ্ন যাত্রার দলিল।

তিনি যখন লেখেন—

“প্রচ্ছদে জমেছে বিস্মরণের হিমপ্রবাহ”,

তখন মনে হয়, তিনি শুধুমাত্র নিজের নয়, বরং সমগ্র পাঠকসমাজের বুকের দীর্ঘশ্বাস প্রকাশ করছেন। এই উপলব্ধির গভীরতাই তাঁর কবিতাকে চিরস্থায়ী করে তোলে।

তাঁর কবিতার শক্তি তাঁর শব্দের মধ্যেই নয়, শব্দের অন্তরালের নীরব সুরে। তিনি যেভাবে সহজ ভাষায় কঠিন অনুভবের কাঠামো নির্মাণ করেন—সেই মুন্সিয়ানা বিরল।

তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে মনে পড়ে—জয় গোস্বামীর গোপন অন্ধকার কিংবা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ধাক্কাধরা শব্দের বিস্ফোরণ। তবুও, জাসমিনা খাতুন তাঁর নারী-অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, এবং অনুচ্চারিত সৌন্দর্যের মাধ্যমে তৈরি করেছেন সম্পূর্ণ নিজস্ব এক স্বর।

সত্যি বলতে, কবি জাসমিনা খাতুন শুধু কবি নন, তিনি অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। তাঁর কবিতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—কবিতা মানেই জীবন, আর জীবন মানেই অক্ষরনিমজ্জন।প্রার্থনা করি—তাঁর লেখনীতে আরও ধার আসুক, আরও গভীরতা আসুক। কবিতা হয়ে উঠুক তাঁর স্পর্শে আরও অদ্ভুত সুন্দর।

ড. শিবাশিস মুখার্জী
অধ্যাপক,
কলকাতা ও সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়✍️

অক্ষরনিমজ্জন ✦
জাসমিনা খাতুন

প্রচ্ছদে জমেছে বিস্মরণের হিমপ্রবাহ,
তিন পাতার ফাঁকে গুঁজে রাখা অপ্রকাশিত দীর্ঘশ্বাস—
বুকের গভীরে জমাট বেদনার জলস্তর।

ছাদের চৌকাঠ ভেদ করে ঝরে পড়ে শব্দ,
হৃদয়দেয়ালে লেপ্টে থাকা কাদা-শ্যাওলার ব্যাকরণে।

বিপর্যয় ভাসিয়ে নিয়ে যায় সহস্র অক্ষর,
জলজ অনুভবে নিমজ্জিত কবিতার প্রাঙ্গণ—
শহরের প্রতিটি কোণ ছেয়ে যায় মগ্ন উচ্চারণে।

ছুঁতে পারি না কিছুতেই—
ইলেকট্রন-আবৃত মেঘমালার অন্তরালে থাকা সেই কবিতাটিকে,
যার সোনালি সজ্জার প্রচ্ছদেও স্পর্শ অসম্ভব,
শিরোনামের অক্ষরগুলিও অনন্ত দূরত্বে।

রামপুরহাট, বীরভূম, ভারত
২৪.০৯.২০২৫

a/j