বিশেষ প্রতিনিধি
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এবার একই প্রতিষ্ঠানের আরেক সদস্য (বোর্ড প্রশাসন) জি এম আবুল কালাম কায়কোবাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে সংস্থাটিতে। গত ১৫ই ডিসেম্বর অনিয়মের মাধ্যমে সম্পদ অর্জনের অভিযোগটি জমা পড়ে। দুদকের ঊর্ধ্বতন এক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। সূত্র বলছে, রাজধানীতে কায়কোবাদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট ও বাণিজ্যিক স্থাপনা রয়েছে। যার বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা।
এতে বলা হয়, রাজস্ব বোর্ডে অনিয়মের জন্য জি এম আবুল কালাম কায়কোবাদ নিজের ছেলেকে ব্যবহার করেন। ছেলের নামে থাকা ল ফার্মের মাধ্যমে করদাতাদের কৌশলে নিয়ম বহির্ভূতভাবে কর আদায় করে সেখান থেকে বড় অঙ্কের অর্থ গ্রহণ করেন তিনি। এতে রাষ্ট্রের করের টাকাও বেহাত হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, কায়কোবাদ তার ছেলেকে দিয়ে ‘ইশতিয়াক ফয়সাল অ্যান্ড এসোসিয়েটস্’ নামক কর উপদেষ্টা ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেই প্রতিষ্ঠানটি সুইট নং-০৩, লেভেল-০৮, ৪০ বিজয় নগর (এলি’স সেন্টারস্থ ঠিকানায়) অবস্থিত। এ প্রক্রিয়ায় প্রথমে যে সকল কোম্পানির নিকট ৫০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে আয়কর পাওনা রয়েছে সে সকল কোম্পানির আইনজীবী হিসেবে অবির্ভূত হন ইশতিয়াক ফয়সাল শুভ। কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি হয় ৫০ কোটি টাকার স্থলে ১০ কোটি টাকায় কিংবা ১০০ কোটি টাকার স্থলে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকায় নিষ্পত্তি করে দেন। চুক্তির পরবর্তীতে ইশতিয়াক আয়কর কর্মকর্তাদের চাপ প্রয়োগ করেন ৫০ কোটির স্থলে ৫ থেকে ৬ কোটি কিংবা ১০০ কোটির স্থলে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকায় মামলা নিষ্পত্তি করতে। এ পর্যায়ে জি এম আবুল কালাম কায়কোবাদ কর কর্মকর্তাদের ফোন দিয়ে চাপ প্রয়োগ করেন।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, জি এম আবুল কালাম কায়কোবাদ কর্মকর্তাদের বদলি প্রমোশনের দায়িত্বে রয়েছেন। তার ভয়ে কর্মকর্তারা বাধ্য হন ৫০ কোটির স্থলে ৫ থেকে ৬ কোটি কিংবা ১০০ কোটির স্থলে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা আয়কর ধার্য করতে। চুক্তিমতো কোম্পানিসমূহ ৫০ কোটির স্থলে ১০ কোটি টাকা পরিশোধ করলে ৫ কোটি টাকা আয়কর হিসাবে জমা করা হয় বাকি ৫ কোটি টাকা কায়কোবাদ আত্মসাৎ করেন। আবার ১০০ কোটি টাকার স্থলে চুক্তিমতো ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা পরিশোধ করলে আয়কর হিসাবে ১০ কোটি টাকা জমা করা হয় বাকি ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা নিজে গ্রহণ করেন।
এনবিআরের কর্মকর্তাদের দেয়া অভিযোগ বলছে, আগে থেকেই কায়কোবাদ এ পদ্ধতি অবলম্বন করলেও কর প্রশাসনের দায়িত্ব পাওয়ায় তার এ কাজ আরও সহজ হয়েছে। কম কর প্রদানের সুযোগ পেয়ে কোম্পানিগুলোও তার দ্বারস্থ হচ্ছে। মাঝ থেকে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার নিশ্চিত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
অবশ্য দুদকের সে অভিযোগের সূত্র ধরে মানবজমিনও সরজমিন তথ্য সংগ্রহ করেছে। এতে দেখা যায়, কায়কোবাদ বসবাস করেন রাজধানীর রমনার সিদ্ধেশ্বরী রোডে। এই সড়কের ৬৭ নম্বর ভবনের সাততলায় তার বাসা। রেজা এভিনিউ নামক ভবনটিতে দুই হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটে কায়কোবাদ তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থাকেন। ভবনটির দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন রাব্বানী নামের এক যুবক। তার সঙ্গে আলাপে নিশ্চিত হওয়া গেছে ফ্ল্যাটটি জি এম আবুল কালাম কায়কোবাদের।
রাব্বানী মানবজমিনকে বলেন, স্যার এই ভবনেই থাকেন। সাততলায় তার বাসা। ফ্ল্যাটটি দুই হাজার স্কয়ার ফিটের। তবে এই ফ্ল্যাট ছাড়া স্যারের আর কোনো বাসা এ ভবনে নেই। রাব্বানী আরও বলেন, ভবনটির বয়স দশ বছর। আমি এখানে কাজ করি দুই বছর হয়েছে।
এ ছাড়া রাজধানীর বিজয় নগরে আলিস সেন্টারে একটি বাণিজ্যিক স্পেস রয়েছে। যা জি এম আবুল কালাম কায়কোবাদের ছেলে ইশতিয়াক ফয়সালের নামে কেনা। এই ভবনের নিরাপত্তারক্ষীর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ভবনের লেভেল-৮ এ ইশতিয়াক ফয়সাল নিজেই বসেন। ওই নিরাপত্তারক্ষী বলেন, উনি তো উকিল জানি। তার বাবা এনবিআরের বড় অফিসার।
এদিকে দুদকে জমা পড়া অভিযোগে জি এম আবুল কালাম কায়কোবাদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে আরও কয়েকটি সম্পদের কথা উল্লেখ করা হয়।
রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে শেলটেক কুঞ্জকুঠির নামক ভবনে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার। যার বাজারমূল্য ৫ কোটি টাকা। পূর্বাচল ১২ নম্বর সেক্টরে পাশাপাশি সাড়ে সাত কাঠার দুটো প্লট রয়েছে যার বাজারমূল্য ১৬ কোটি টাকার বেশি। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আই ব্লকে ৯ তলা বাড়ি রয়েছে যা ৫ কাঠা জমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি একই এলাকার কে ব্লকে ১০ কাঠার আরও একটি প্লট রয়েছে যার বাজারমূল্য ২৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া ধানমণ্ডির ১০-এ তে স্ত্রীর নামে ৩ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন বলেও অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। দেশের পাশাপাশি কানাডাতেও ৫০ কোটি মূল্যের সম্পদ রয়েছে বলে জানানো হয়।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে একাধিকবার কল করা হয় জি এম আবুল কালাম কায়কোবাদকে। তিনি মুঠোফোনটি রিসিভ করেননি। একপর্যায়ে মুঠোফোনে খুদে বার্তায় বক্তব্যের বিষয়ে অবহিত করা হয়। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপেও তাকে খুদে বার্তা পাঠানো হয়েছে। তাতেও সাড়া মেলেনি।
আপনার মতামত লিখুন :