বিবিসি বাংলার রেডিও’র সম্পচার বন্ধ হয়ে গেল


প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ৫, ২০২৩, ১০:৪৫ পূর্বাহ্ন / ৫১০
বিবিসি বাংলার রেডিও’র সম্পচার বন্ধ হয়ে গেল

 

এম. জুলফিকার আলী ভূট্টো, বিশেষ প্রতিনিধি-

আমাদের দেশের নির্ভর যোগ‍্য গণমাধ‍্যম ছিল বিবিসি বাংলা। বিবিসি থেকে বাংলা অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয় ১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর। ৮১ বছর ধরে রেডিও অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পর সম্প্রতি অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হল, ঘোষণা মোতাবেক গত ৩১ ডিসেম্বর-২০২২ খ্রি. তারিখে বিবিসি থেকে বাংলা অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ হয়ে গেল।

বিবিসি শুধু একটি বেতার কেন্দ্র নয়, এটি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাথী, অসংখ্য শ্রোতার ভালোবাসার জায়গা। আমি বিবিসির একজন শ্রোতা ছিলাম। কত স্মৃতি, কত আবেগ, কত ভালোবাসা জড়িয়ে আছে এর সাথে। সে সব সোনালী দিনগুলো না থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিবিসি রেডিওর সাথেই ছিলাম। সাথে থাকারই স্বপ্ন ছিল। তাই, আশা করে ছিলাম, প্রত্যাশা করে ছিলাম, বিবিসি বাংলা রেডিও সার্ভিস বন্ধ হবে না।

বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান যারা আলোকিত করেছেন তারা হলেন-শাকিল আনোয়ার, সাবির মোস্তফা, শারমিন রমা, শুভ জ্যোতি ঘোষ, মানুষী বড়ুয়া, পুলক গুপ্ত, কাদির কল্লোল, আকবর হোসেন, মাসুদ হাসান খাঁন, মিজানুর রহমান খাঁন, মোয়াজ্জেম হোসেন, শাহনাজ পারভীন, আবুল কালাম আজাদ, সাইফুল ইসলাম ও রায়হান মাসুদ প্রমুখ। বিগত দিনে তাদের উপস্থাপনার মাধ্যমে শুনছি। তাদেরকে আর শুনতে পারব না এটা সত্যি মেনে নেয়ার মত নয়।

বিভিন্ন কারণে আগে থেকেই যাদের শুনতে পারছি না তারা হলেন-সুবীর ভৌমিক, আনিস আহমেদ, তৌফিক ইমরোজ খালিদী, আতিকুস সামাদ, সিরাজুর রহমান, মাসুদা ভাট্টি ও উদয় শংকর দাশ আরও অনেকে রয়েছেন তাদের নাম এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না। বিবিসি বাংলা রেডিওর সম্প্রচার বন্ধের বিষয়টি আমিসহ অনেকের জন্যই মন খারাপ করা খবর। বিবিসির সঙ্গে আমাদের অনেকেরই দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক। বিবিসি’র সাথে সেই ছোট বেলা থেকেই সম্পর্ক আমার।

জানা যায় ১৯৪১ সাল থেকে বাংলায় সম্প্রচার শুরু হওয়া বিবিসি রেডিওর পূর্ণাঙ্গতা পায় ১৯৬৫ সালে। বিশ্বস্ত সংবাদ পরিবেশনা এবং সংবাদ বৈচিত্র্যের কারণে অনেকেই রুটিন করে বিবিসির সংবাদ শোনেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই বাংলাভাষী মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে বিবিসি বাংলা। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনের খবর যেমন বিবিসি বাংলা রেডিওতে শোনা যেত তেমনি মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্ভর যোগ্য খবরের জন্য বিবিসি বাংলা রেডিওই ছিল ভরসা।

এক সময় বিবিসি বাংলার নিয়মিত ৪টি অনুষ্ঠান থেকে দুটি বাদ দেওয়া হয়। এখন বিবিসি বাংলা দুটি রেডিও অনুষ্ঠান সম্প্রচারে ছিল।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, বহুল প্রচারিত, জনপ্রিয় ও শ্রোতা নন্দিত বিবিসি বাংলা রেডিও’র অনুষ্ঠান সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টার প্রবাহ এবং রাত সাড়ে ১০টার পরিক্রমা চলে আসছিলো।

বিবিসি বাংলা হল বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের অধীনে বিদেশী ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষায় সম্প্রচারিত বিবিসির একটি বিভাগ। বিবিসি বাংলা বাংলাদেশ, তার প্রতিবেশী এবং গোটা বিশ্বের সংবাদ পরিবেশন করে। সংবাদদাতার প্রতিবেদন ছাড়াও বিবিসি বাংলা সাক্ষাৎকার, সংবাদ পর্যালোচনা এবং সরাসরি ফোন-ইন প্রচার করে আসছিল। বাংলাভাষী বেতার শ্রোতার কাছে এটি জনপ্রিয় হয়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে এর নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচারের কারণে এটি বিপুল জনপ্রিয়তা ও বিশ্বাস যোগ্যতা অর্জন করে ছিল

 

 

বিবিসি বাংলা বিভাগের অনুষ্ঠান লন্ডনের নিউ ব্রডকাস্টিং হাউজের সদর দপ্তর থেকে এফ.এম, মিডিয়াম ওয়েভ ও শর্টওয়েভে সমগ্র বিশ্বে সম্প্রচারিত হয়। তাছাড়া ঢাকা, দিল্লি ও কোলকাতা ব্যুরো অফিসে এ বিভাগের সম্প্রচার ত্বরান্বিত করতে অনেক সংবাদকর্মী কাজ করে ছিলেন।

যেখানে থাকে সংবাদ, নানা ধরনের ম্যাগাজিন, শ্রোতাদের চিঠিপত্রের আয়োজন। ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন, সংক্ষেপে বিবিসি, যুক্তরাজ্য ভিত্তিক একটি গণমাধ্যম সংস্থা। বিবিসি বাংলার আয়োজন বাংলাদেশ সংলাপ বাংলাদেশের স্যাটেলাইট চ্যানেল “চ্যানেল আই”এর সহযোগিতায় সম্প্রচারিত একটি অনুষ্ঠান, যেটি বিবিসি বাংলা রেডিওতে এবং বিবিসি বাংলায় সমসাময়িক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে শ্রোতা, দর্শক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সরাসরি অংশগ্রহণে এ অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। ‘বাংলাদেশ সংলাপের’ প্রতিটি অনুষ্ঠানে শ্রোতারা আমন্ত্রিত প্যানেল সদস্যদের কাছে তাদের প্রশ্ন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রশ্নের উত্তর নিয়ে মতামত দেন। অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তি ছিল ৫০ মিনিট।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হতে বিবিসি বাংলা শোনা একজন বেতার শ্রোতা খাগড়াছড়ির মো. আ. রশিদ বিবিসি বাংলার সম্প্রচার বন্ধ হওয়া সম্পর্কে বলেন, মানুষের অতি প্রয়োজনীয় অতি শক্তিশালী সত্যনিষ্ঠা গণমাধ্যম বিবিসি বাংলা রেডিও প্রচার আজ থেকে বিদায়। বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান থেকে বিদায় বিবিসি বাংলা। এক সময় গ্রামের লোকজন মন প্রাণ উজাড় করে শুনতো বিবিসি বাংলা। বিবিসির বিদায়ের বেলা মনে হয় আমার রেডিও শোনা আর হবে না।

গত ৩০ ডিসেম্বর-২০২২ খ্রি. তারিখে বিবিসি বাংলার রাত সাড়ে দশটার পরিক্রমা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে ছিলেন, বিবিসি বাংলার মোয়াজ্জেম হোসেন, শেষ উচ্চারণে তিনি শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেন এত দিন যারা বিবিসি বাংলার সাথে ছিলেন, তাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ এবং বিবিসি বাংলার রেডিও সম্প্রচার থেকে বিদায় নিলাম আমি মোয়াজ্জেম হোসেন।

ভবদিয়া, রাজবাড়ী সদর, রাজবাড়ীর বেতার শ্রোতা শাহিন আলী বলেন, বিবিসি বাংলার সাথে ১৯৯৬ সাল থেকে সাথে ছিলাম। একদিনও বিবিসির সংবাদ না শুনলে দিনটা ভালো যেতো না। প্রিয় বিবিসি বাংলা আজ বন্ধ হয়ে গেল, এতে আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।

আজ থেকে বন্ধ হয়ে গেল বিবিসি বাংলার রেডিও অনুষ্ঠান। আমার বিদ্যুৎ চালিত টেপ রেকর্ডার এ শুনছিলাম শেষ অনুষ্ঠানটি আর স্মৃতিময় অতীতকে মনে করে মনের অজান্তেই চোখের কোনে নোনা জলের উপস্থিতি অনুভব করছি। আর ছোট ডিভাইসে অডিও রেকর্ড করার চেষ্টা করছি।। আমার মতো হাজারো বাঙ্গালী আজীবন স্মরণ থাকবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচার এবং মুক্তিকামী বাংলার আপামর জনতাকে উৎসাহ, অনুপ্রেরণার রসদ যোগানো বিবিসি বাংলাকে বিদায় উপরোক্ত কথা গুলো বললেন, হরিণাকুন্ডু, ঝিনাইদহের বেতার শ্রোতা মো. আলী হোসেন।

ঢাকা সাভারের চড়ুইভাতি বেতার শ্রোতা ফাউন্ডেশনের, সভাপতি, শাহাদাত মেম্বার জানান, যুগ যুগ ধরে শুনে আসা বিবিসি বাংলা রেডিও সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যাওয়া এটি মোটেও কাম্য নয়।
এতে করে আমরা বিশ্বের অনেক সঠিক তথ্য জানা থেকে বঞ্চিত হব। আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি, বিবিসি বাংলা সম্প্রচার চালু রাখা হোক।

বিবিসি বাংলা বেতার বন্ধ হওয়ার বিষয়টি আমি সংবাদকর্মী হিসেবে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে! পৃথিবীর এনালগ সময়ে গ্রাম-বাংলার সাধারণ ও দেশপ্রেমী মানুষের মনের খোরাক জোগাত বেতার। আজ আধুনিকতার কাছে এনালগ সিস্টেম পরাজিত হওয়ায় বিশ্ব নন্দিত ও স্রোতা মধুর বিবিসি বাংলা বেতার ইতিহাস থেকে এভাবে হারিয়ে যাবে সেটা ছিল অপ্রত্যাশিত। এ ভাবে জননন্দিত বেতার বার্তার অপমৃত্যু না করে আধুনিকায়ণে এগিয়ে আনার দাবী করছি। এ ভাবে মতামত প্রকাশ করলেন, দৈনিক আজকের পত্রিকার মানিকছড়ি প্রতিনিধি আবদুল মান্নান। ৩১ ডিসেম্বর বিবিসি বাংলা রেডিওর শেষ দিন। এত দিনের অভ্যাস ১ জানুয়ারী হতে থেকে যাবে শুধুই ইতিহাস হয়ে।

৩১ ডিসেম্বর বিবিসি বাংলা’র শেষ বেতার অনুষ্ঠান রাত সাড়ে ১০ টার পরিক্রমা অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনায় শেষ বারের মত মানুষী বড়ুয়া, অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন বিবিসি বাংলার সাবেক প্রধান, সৈয়দ মাহমুদ আলী এবং বর্তমান বিবিসি বাংলার প্রধান সাবির মোস্তফা প্রমুখ। আলোচনায় তারা পূর্বের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন, ওই অধিবেশনে বিশ্ব সংবাদ পাঠ করে শোনান পুলক গুপ্ত। শেষে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক মানুসী বড়ুয়া সকল বেতার শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেন এতদিন যারা বিবিসি বাংলার সাথে ছিলেন, তাদের সবাইকে অসংখ্য অগণিত ধন্যবাদ জানিয়ে অধিবেশন এবং অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

বিবিসি সুত্র জানা যায়, ডিজিটাল মিডিয়ার উত্থান, শ্রোতাদের চাহিদার বিবর্তন আর মিডিয়া প্রযুক্তির দ্রুত বদলে যাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিবিসি বাংলা এখন আর শুধু রেডিও নয় রেডিও’র পরিবর্তে থাকবে বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে।

 


There is no ads to display, Please add some