এম. জুলফিকার আলী ভুট্টো, বিশেষ প্রতিনিধি-
কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক বিশিষ্ট বেতার শ্রোতা ও বেতার সংগঠক মো.
শাহাদত হোসেন’র আজ শুভ জন্মদিন। বাংলাদেশে যে কয়জন বিখ্যাত ডিএক্সার আছেন, তাদের মধ্যে মো. শাহাদত হোসেনের তাদের মধ্যে অন্যতম। কলেজের অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি দীর্ঘদিন ধরে নিরলস ভাবে ডিএক্সইং করে যাচ্ছেন, বেতার শ্রোতাদের সাথে যোগসূত্র তৈরি করছেন, শ্রোতাদের নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলছেন, আয়োজন করছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। মো. শাহাদত হোসেন আইআরআইবি ফ্যান ক্লাব কিশোরগঞ্জের সভাপতি, কিশোরগঞ্জ কেন্দ্রীয় বেতার শ্রোতা সংঘের প্রধান উপদেষ্টা ও গুরুদয়াল সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
শুভ জন্মদিন উপলক্ষে এক আলাপচারিতায় তিনি বলেন বেতার শুনুন, বিশ্বকে জানুন। এ স্লোগানের মর্মকথা উপলব্ধি করেই বিশ্বের অনেক মানুষ রেডিও শুনতেন, এখনো শুনেন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনবদ্য অবদান রয়েছে। সে জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উত্তরসূরী বাংলাদেশ বেতারকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। শুধু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিবিসি বাংলা ও ভয়েস অব আমেরিকারও অবদান রয়েছে। মানুষ নিরপেক্ষ ও সঠিক সংবাদের প্রত্যাশায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, বিবিসি বাংলা ও ভয়েস অব অ্যামেরিকার অনুষ্ঠান শুনার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতো। উল্লেখ যে, আন্তর্জাতিক বেতারের এসব শ্রোতারাই এক সময় ডিএক্সইংয়ে আত্মনিয়োগ করেন। ডিএক্সইং এমন একটি ছবি, যার প্রথম ধাপ হ’ল আন্তর্জাতিক বেতারের অনুষ্ঠান শুনা, তারপর সে অনুষ্ঠান সম্পর্কে সংশিষ্ট বেতার কেন্দ্রে মতামত ও শ্রবণমান রিপোর্ট প্রেরণ করা, কিউএসএল কার্ড বা ভেরিফিকেশন কার্ড সংগ্রহ করা। ব্যয়বহুল এ শখটি অল্প সংখ্যক লোকেরই রয়েছে।
তিনি এই প্রতিবেদককে আরও জানান স্কুল জীবন থেকেই শাহাদত হোসেন ডিএক্সইংয়ে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮১-৮২ সালে তিনি যখন নবম/দশম শ্রেণির ছাত্র তখন বাংলাদেশ ডিএক্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনালের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। এরপর সে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইকবাল খন্দকারের সাথে দীর্ঘদিন রেডিও শুনা ও ডিএক্সইং নিয়ে কাজ করেন। মজার ব্যাপার হ’ল, তার, জন্ম তারিখটা তার চাচা লিখে রেখে ছিলেন ভয়েস অব আমেরিকার একটি ক্যালেন্ডারের পাতায়। জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, ফান্স, রাশিয়া, রোমানিয়া, ফিনল্যান্ড, গ্রীস, অস্ট্রিয়া, ভ্যাটিকান, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কিউবা, ইকুয়েডর, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইরান, কুয়েত, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইনস, চীন, পাকিস্তান, ভারতসহ বিশ্বের প্রায় ৫০ টিরও অধিক দেশের বেতার কেন্দ্রের সাথে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন, চিঠি লিখতেন, মতামত পাঠাতেন, রিসেপশন রিপোর্ট পাঠাতেন। বিনিময়ে সেসব বেতার কেন্দ্র থেকে পেতেন আকর্ষণীয় সব উপহার সামগ্রী। তন্মধ্যে রেডিও, কিউএসএল কার্ড, ভিউ কার্ড, স্টীকার, প্যানেন্টস, বই, ম্যাগাজিন, মানচিত্র, ঘড়ি, টি- শার্ট, পুতুল, তাওয়ালে, কোটপিন, মোবাইল, মাউসপ্যাড, রুমাল, আইপড, এমপিথ্রি পেয়ার, টাই প্রভৃতি বিশেষ ভাবে উলেখ যোগ্য।
আসলে তার বাসার ঠিকানায় বা তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতেন তখনে হলে প্রতিদিন এত বেশি চিঠি আসত যে ডাকপিয়নও অবাক হয়ে যেত! মাঝে মধ্যে বড় বড় খামে এত বেশি চিঠিপত্র আসত যে সেগুলো ডাকপিয়নের পক্ষে নিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। ফলে তিনি চিঠিগুলো পোস্ট অফিস থেকে নিয়ে আসার জন্য বলে যেতেন।
মো. শাহাদত হোসেন যখন সুনামগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজে তখন তিনি চিঠি পোস্ট করতে গেলে পোস্ট অফিসের অনেকেই এসে তার সাথে দেখা করতেন। কেননা এত চিঠি যার কাছে আসে তাকে দেখার আগ্রহ তাদের ছিল। তারা জানতে চাইতেন, তার কাছে বিদেশ থেকে এত চিঠি কেন আসে, কারা পাঠায়, এসব চিঠিতে কী আছে। নানা উপহার সামগ্রী পাওয়ার কারণে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তার বেশ কিছু নতুন বন্ধু সৃষ্টি হয়। তিনি তাদের সে সব উপহার সামগ্রী বিলিয়ে দিতেন রেডিওর অনুষ্ঠান শুনা আর বেতার কেন্দ্রে চিঠি লেখা তার অন্যতম শখ। পেশাগত জীবনেও তিনি তার এ শখকে হারিয়ে যেতে দেন নি। মূলতঃ একজন বেতার শ্রোতার আগ্রহ থাকে ডিএক্সইং করার, একজন ডিএক্সারের আগ্রহ থাকে বিভিন্ন বেতার কেন্দ্রের মনিটর হিসেবে কাজ করার। শাহাদত হোসেন ডয়চে ভেলে, বিবিসি বাংলা ও এনএইচকে’র মনিটর হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। এসব বেতার কেন্দ্র থেকে পেয়েছেন সম্মানী ও মূল্যবান উপহার। বর্তমানে তিনি রেডিও তেহরানের মনিটর হিসেবে কাজ করছেন।
তবে গত কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বেতার কেন্দ্রগুলো তাদের শর্টওয়েভ সার্ভিস বন্ধ করে দিয়েছে বা সীমিত করে ফেলছে। এসব বেতার কেন্দ্র এখন নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে। ফলে ডিএক্সইং ছবিটা ক্রমশই হারিয়ে যেতে বসেছে। অন্য দিকে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ বেতারও নতুন নতুন উপায়ে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে। এ দিকে আন্তর্জাতিক বেতারের শ্রোতারাও বাংলাদেশ বেতারের দিকে ঝুঁকছে। আন্তর্জাতিক বেতার কেন্দ্রগুলো যেমন তার শ্রোতাদের গঠিত ক্লাবকে অনুমোদন দিত, বাংলাদেশ বেতারের পরিচালক সায়েদ মোস্তফা কামালের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ বেতারও তার শ্রোতাদের দ্বারা গঠিত ক্লাবগুলোকে অনুমোদন দেয়ার উদ্যোগ নেয়। ফলে সারা দেশে প্রায় দু’হাজারের বেশি শ্রোতা ক্লাব গড়ে উঠে।
ডিএক্সার শাহাদত হোসেনও শ্রোতা ক্লাব গড়ে তুলেন এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে থাকেন। গত কয়েক বছরে কিশোরগঞ্জ কেন্দ্রীয় বেতার শ্রোতা সংঘ, আইআরআইবি ফ্যান ক্লাব কিশোরগঞ্জের সহায়তায় বেশ কয়েকটি শ্রোতা সম্মেলনের আয়োজন করে, যেগুলো শ্রোতামহলে খুব প্রশংসিত হয়েছে। এসব অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালকসহ বিভিন্ন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন, ছিলেন রেডিও তেহরানের সাংবাদিকও।
কিশোরগঞ্জ কেন্দ্রীয় বেতার শ্রোতা সংঘের প্রতিটি অনুষ্ঠান বৈচিত্র্যময়। তারা প্রতি বছর ৬/৭টি অনুষ্ঠান আয়োজন করে এবং একেকটি অনুষ্ঠান একেক অঞ্চলে করে থাকে। ফলে শ্রোতারা যেমন নতুন একটি এলাকা সম্পর্কে ধারণা পান, আবার ঐ এলাকার লোকজনও বেতার সম্পর্কে জানার সুযোগ পান। তাদের এ দৃষ্টিভঙ্গি অনেকের নজর কেড়েছে।
এছাড়া আইআরআইবি ফ্যান ক্লাব কিশোরগঞ্জের মাধ্যমে তিনি শ্রোতাদের মাঝে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন এবং বিজয়ীদের পুরস্কৃত করেন। পুরস্কারের মান ও বৈচিত্র্য সকলের ভালো লেগেছে।
শাহাদত হোসেন শুধু একজন শ্রোতা বা ডিএক্সার নন, তিনি একজন শ্রোতা সংগঠকও। কিশোরগঞ্জ কেন্দ্রীয় বেতার শ্রোতা সংঘ, আইআরআইবি ফ্যান ক্লাব কিশোরগঞ্জ, ইন্টারনাশনাল লিসেনার্স ক্লাব প্রভৃতি শ্রোতা সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারে তার অনন্য ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশে যেসব আইআরআইবি ফ্যান ক্লাব গড়ে উঠেছে, সে সব ক্লাবের উদ্যোক্তাদের সাথেও তিনি সক্রিয় ভাবে সহযোগিতা করেছেন। একজন নিয়মিত শ্রোতা ও সক্রিয় সংগঠক হিসেবে ইতোমধ্যে তিনি বেশ কয়েকটি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তন্মধ্যে ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালে তিনি রেডিও তেহরানের শ্রেষ্ঠ শ্রোতা মনোনীত হন। এ ছাড়া ২০২১ ও ২০২২ সালে আইআরআইবি ফ্যান ক্লাব কিশোরগঞ্জ রেডিও তেহরান থেকে শ্রেষ্ঠ কর্মমুখর ক্লাব হিসেবে স্বীকৃতি পায়। অন্য দিকে ২০২৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বেতার দিবস উপলক্ষে ঢাকায় বেতার ভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ বেতার থেকে তাকে শ্রেষ্ঠ সংগঠক হিসেবে পুরস্কৃত করা হয়।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দু’সন্তানের জনক। তার স্ত্রী শরিফা আক্তার পান্নাও একজন একনিষ্ঠ বেতার শ্রোতা। তার মেয়ে শাইরা হোসেন ম এনএইচকে ওয়ার্ল্ড রেডিও জাপান থেকে জাপানি গানে সেরা হওয়ার পুরস্কার পেয়েছে। মেয়ে শাইরা হোসেন ও ছেলে শাদমান হোসেন অয়নও বাবা-মা’র সাথে রেডিও শুনতে ভালোবাসে। একজন বেতার শ্রোতা, ডিএক্সার ও সংগঠক হিসেবে শাহাদত হোসেন সারা দেশের বেতার শ্রোতাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। সক্রিয় থাকেন সামাজিক যোগাযোগ মাধমেও। সারা দেশের শ্রোতাদের সংগঠিত হওয়ার এবং বেতারের শিক্ষা ধারণ করার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। তিনি সারা দেশের শ্রোতাদের এক প্লাটফর্মে এনে সুন্দর একটি দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেন। আজ বিশিষ্ট বেতার শ্রোতা ও সংগঠক এবং শিক্ষানুরাগী মো. শাহাদত হোসেন’র শুভ জন্মদিন। শুভ জন্মদিন উপলক্ষে এই বিশিষ্ট বেতার শ্রোতার দীর্ঘায়ু সার্বিক সফলতা কামনা করি।
আপনার মতামত লিখুন :