ভালবাসা, ঘৃণা ও চাওয়াহীন মহাজ্ঞানীদের কথা


প্রকাশের সময় : জুলাই ১১, ২০২৪, ৯:১৯ পূর্বাহ্ন / ১১১
ভালবাসা, ঘৃণা ও চাওয়াহীন মহাজ্ঞানীদের কথা

নুর মোহাম্মদ

কিছু বিশেষায়িত জ্ঞানী-গুণীজন যেমন যে বিজ্ঞানী বাল্ব আবিষ্কার করেছে, যে দু’ভাই বিমান আবিস্কার করেছে এরকম বিভিন্ন শ্রেণীর আবিস্কারক আছেন। পাশাপাশি প্রত্যেক শ্রেণী পেশার মাঝে অনেক আলোকিত ও ব্যক্তিত্ববান মানুষ আছেন।

নবী-রাসূল, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, গবেষক, সূফী- সাধক, চিকিৎসক, কবি, সাহিত্যিক, লেখক এসব আবিস্কারক, উদ্ভাবক ও সৃজনশীল গুণের মানুষজন বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে মানবসভ্বতার ক্রমোন্বতি, জ্ঞান-শিক্ষা বিস্তার, প্রতিভা বিকাশ ও কর্মকৌশল শিখিয়ে বিশ্ববাসীকে আলোকিত করেছেন নিজেদের সৃষ্টিশীলতা ও মেধা দিয়ে।

এসব মহাজনদের অনেকে কখনো কারো ভালবাসা, অবহেলা, অশ্রদ্বা, হিংসা, বিদ্রুপ ও উপহাসের কোন তোয়াক্কা করেননি। এসব মহান ব্যক্তিরা পারিবারিক সামর্থ্য, ব্যক্তিগত চেষ্টা, সরকারী- বেসরকারী পৃষ্টপোষকতা বা কোন আলোকিত ব্যক্তির উৎসাহ, দীক্ষা ও সহযোগিতায় নিজের প্রতিডা বিকশিত করেছে।

উদাহরণ হিসেবে একজন বলা যায় একজন বিশ্বসেরা মহাজ্ঞানীর কথা। তিনি হলেন ইবনে সিনা। তিনি একাধারে চিকিৎসা বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও দার্শনিক। পুরো নাম আবু আলী হোসাইন ইবনে আবদুল্লাহ আল হাসান ইবনে আলী ইবনে সিনা।

তিনি ৯৮০ সালের শেষের দিকে বুখারার (বর্তমান উজবেকিস্তান) অন্তর্গত খার্মাতায়েন জেলার আফসানা এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। গোটা পৃথিবীতেই তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী মানুষ বলে পরিচিত ছিলেন। তাঁকে একই সঙ্গে ইরান, তুরস্ক, আফগানিস্তান ও রাশিয়ার বিজ্ঞজনেরা তাঁদের জাতীয় জ্ঞান বীর হিসেবে ঘোষণা করেছেন। মধ্যযুগীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভিত রচনায় তিনি অনন্য অবদান রেখেছেন।

ইবনে সিনা মূলত অ্যারিস্টটল, প্লেটো ও অন্যান্য দর্শনের ওপর ব্যাপক জ্ঞানার্জন করেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন; এর মধ্যে ছিল বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিতশাস্ত্র, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র ও সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে অসীম জ্ঞানের অধিকারী হন। ২১ বছর বয়সে ‘আল মজমুয়া’ নামে একটি বিশ্বকোষ রচনা করেন। এর পেছনে তাঁর তিনজন গৃহশিক্ষকের অবদান ছিল। তাঁর মূল অবদান ছিল চিকিৎসাশাস্ত্রে। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের বিশ্বকোষ ‘আল-কানুন ফিত-তিব’ রচনা করেন, যা ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্য ছিল। পাঁচ খণ্ডের এ বইটিকে বলা হয় চিকিৎসাশাস্ত্রের বাইবেল। ইবনে সিনার বিশেষ গুণ- জ্ঞানের কারণে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাহার রচিত বইগুলোকে।

অন্য দিকে হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা ( সা:) এর সাহাবীদের মাঝে হযরত কাব (রা.) ছিলেন তাঁর সময়ের একজন উত্তম কবি জাহেলি যুগেই তিনি কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কাব (রা.) ছিলেন তাঁর সময়ের একজন উত্তম কবি। আরবের গোত্রগুলিতে কবি হিসেবে তাঁর নাম পরিচিত ছিল।

রাসুল (সা.) হুনাইন যুদ্ধ শেষ করে তায়েফের দিকে যাত্রা করার সময় হজরত কাব ইবনে মালিক (রা.) দুটি কবিতা লেখেন। কবিতাটি দাউস গোত্রের ওপর এত প্রভাব ফেলে যে তারা তা শুনেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।

কাব (রা.)–এর বর্ণনা করা হাদিসের সংখ্যা ৮০। ইসলাম গ্রহণের পর থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এর সেবায় তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। হাতে কলম নিয়ে যেমন ভাষার যুদ্ধ করেছেন, প্রয়োজনের মুহূর্তে তেমনই হাতে তলোয়ারও তুলে নিয়েছেন। কাব ইবনে মালিক (রা.) ছিলেন আনসার সাহাবি। সততা ছিল তাঁর চরিত্রের একান্ত বৈশিষ্ট্য। কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি সত্য বলতে কুণ্ঠিত হতেন না।

এরকম বিভিন্ন মহাকালের কালক্রমে এরকম মহাজ্ঞানীরা আমাদের চলার পথ, জীবন পথ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথকে সহজ করে দিয়েছেন। আজীবন তাহাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শুকরিয়া আদায় করে শেঢ করা যাবে না। তারাই তো কালজয়ী মহাপুরুষ। নিজেদের চাওয়া, আত্ম অহমিকা বা কোন কিছুর বিনিময়ের জন্য তাহারা এসব করেনি।

এসব করার মূল লক্ষ ছিল মহান আল্লাহর সন্তুস্টি, মানবতার কল্যাণ, শিক্ষার স্থায়ী উপকরণ প্রকাশ করা। সে সব শিখে, জেনে ও বুঝে কালের পর কাল যাতে পৃথিবীর মানুষজন সুফল ও সেবা ভোগ করতে পারেন। কারো ভালবাসা, ঘৃণা, চাওয়া-পাওয়ার আশা না করে আজীবন তারা নিজেদের আলোজিত কর্ম দিয়েই দেশ ও বিশ্ব সমাজকে আলোকিত, সমৃদ্ধ করেছেন।

★ লেখক : কবি ও সাংবাদিক,
রাউজান, চট্টগ্রাম।


There is no ads to display, Please add some