আহমেদ ফজলুর রহমান মুরাদ
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে ১৯৭১ সালের ১লা মার্চের পুর্ব পর্যন্ত একটি ধাপ এবং ১লা মার্চ ‘৭১ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতাদেশ ঘোষনা পরবর্তী আরেক ধাপ।আর এ ক্ষেত্রে আ স ম রব কর্তৃক ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম মহান স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, শাহজাহান সিরাজ কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে মহান স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠ,বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ঘোষণা ও ২৩শে মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসকে প্রতিরোধ দিবস ঘোষণা করে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে সারাদেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেওয়া হয়।এই চারটি দিবস আমাদের পাকিস্তানের সাথের সমস্ত আলোচনা পাকিস্তানি ক্ষমতার আস্বাদনকে ভেস্তে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে অনিবার্য করে তোলে।এখান থেকে পিছিয়ে আসার সব পরিকল্পনা হারিয়ে যায়।ফলে যারাই তখনো পাকিস্তানের ক্ষমতায় বসার সপ্ন দেখছিলেন তারাও মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে অনিবার্য মেনে নিতে বাধ্য হন।আমরা যারা সেই দিনের ঘটনাপঞ্জির সাক্ষী আমাদের স্পষ্টত মনে আছে ১লা মার্চের পরেই থেকেই বাঙ্গালি জাতি বিশ্বাস করতে শুরু করে লড়াই ছাড়া পাকিস্তানি উপনিবেশ থেকে মুক্তির ভিন্ন পথ নেই।। আজকে এই চারটি দিবস আর এর কুশিলব বা পিছনের নায়কদের অস্বীকার বা দুরে রেখে বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস রচনা করা যাবে না।।আর এসব ঘটনার মাষ্টার মাইন্ড একজনই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার সিরাজুল আলম খান।। কিছু কিছু ছবি আর ভারতীয় বিভিন্ন নেতাদের সাথে কি আলোচনা হয়েছে সেটা একটি অংশ হতে পারে তবে সেটাই ইতিহাস নয়।
আওয়ামীলীগ তাদের চেতনায় যে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিবেচনা করে তার ইতিহাস যা আমরা ১৯৭২-৭৫ এদেশে দেখেছি সেটাই যদি হয়, তবে আওয়ামীলীগ এর সাথে স্বাধীনতার চেতনাগতভাবেই ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক।। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিলো জনযুদ্ধ যার জন্য এগুলো সবটাই ছিল জনযুদ্ধের প্রারম্ভিক প্রস্তুতি। এর সাথে জেনারেল জিয়া বা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের কোন সম্পর্ক নেই। তারা আমাদের জনযুদ্ধ শুরু করার পরে এসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাথে যুক্ত হয়েছেন ফলে এই মুক্তিযুদ্ধের বিষয় তাদের সাথেও একটি মতপার্থক্যের অবকাশ রয়েছে। তারাও মনে করেন একটা সামরিক ঘোষণা দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের সুচনা হয়ে গিয়েছিল। এবিতর্ক তারা শুরু থেকেই জিইয়ে রেখেছিলেন। তারা তাদের নিজেদের মধ্যে সব মুক্তিযুদ্ধের খেতাব বন্টন করে নিয়েছিলেন। ভাবখানা এমন যেন তারাই মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ সাধীন করে দিয়েছেন দেশের জনগণ বাকিদের কোন ভূমিকা ছিল না।
যারা মেজর জিয়াউর রহমানকে ঘোষকের দাবিদার তাদের আগে বুঝতে হবে মুক্তিযুদ্ধ আর সেনা বিদ্রোহ এক জিনিস নয়।জিয়া যদি স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়ে থাকেন তবে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি হয়ে যাবে। একজন সামরিক জেনারেল সেনাবিদ্রোহ করে একটি দেশের শাসন ক্ষমতা দখল করতেই পারেন যেমন ইরাকের সাদ্দাম হোসেন লিবিয়ার গাদ্দাফিও ইরাক ও লিবিয়ার শাসন ক্ষমতা দখল করেছিলেন।কিন্তু বাংলাদেশ একটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে।। জিয়াউর রহমানের ২৭ শে মার্চের ঘোষণা আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি ইতিবাচক দিক কিন্তু সেটা কোনভাবেই স্বাধীনতার ঘোষণা হতে পারে না।।
কেন এমনটা হয়েছে কেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া সমর নায়কদের আওয়ামীলীগ ধারন করতে পারলো না এর মুল কারন কি ছিলো?? আওয়ামীলীগ চেয়েছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্র ক্ষমতা সেটা না পেয়ে তারা সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশকে শুধুমাত্র স্বাধীন পুর্বপাকিস্তান বিবেচনা করেছিল। শুধুমাত্র পাকিস্তান এর জায়গায় বাংলাদেশ বসিয়ে দিয়ে তারা পাকিস্তানি কাঠামোয় পাকিস্তানি আমলা,পাকিস্তানি আইন, পাকিস্তানি প্রশাসন দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল যে কারনে নব বাংলাদেশ সৃষ্টির চেতনার মুক্তিযোদ্ধারা কেউ আওয়ামীলীগের পাশে দাড়ায় নি।তারা আওয়ামীলীগের স্বাধীনতাত্তোর ব্যাপক লুটপাট, রিলিপচুরি,কম্বল চুরি দখলবাজি,চোরাচালানকে মেনে নিতে পারে নাই।।
আর এ কারনেই আজকে স্বাধীনতার এতো বছর পরে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি ঘোষণা নিয়ে স্বাধীনতার নুতন ইতিহাস রচনা করতে চাইছে।তারা আজ সবাইকে অস্বীকার করার একটা মানসিকতায় ভুগছে।আজকে তারা সমগ্র স্বাধীনতার ইতিহাসকেই অস্বীকার করছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আফতাব আহমেদকে অস্বীকার করা মানে জয়বাংলা স্লোগানকে অস্বীকার, কাজি আরেফকে অস্বীকার মানে স্বাধীনতার পতাকাকে অস্বীকার। সিরাজুল আলম খানকে অস্বীকার করার অর্থ সমগ্র স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা।
ইতিহাসকে বানিয়ে লেখা যায় না। ইতিহাস লিখতে হলে উপাদান লাগে।যার উপরে ভিত্তি করে ইতিহাস লিখতে হয়।। লরেন্স লিফশুলজ-এর ‘অসমাপ্ত বিপ্লব’, হায়দার আকবর খান রনো-এর ‘মার্কসবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম’, আলতাফ পারভেজ-এর ‘মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী’, মনিরুল ইসলাম(মার্শাল মনি)-এর ‘জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র’, তালুকদার মনিরুজ্জামান-এর ‘Radical Politics and the Emergence of Bangladesh’ ও, ‘The Bangladesh Revolution and Its Aftermath’, জাতীয় অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ এ. এফ. সালাহউদ্দিন আহমদ-এর ‘Bengali Nationalism and the Emergence of Bangladesh: an Introductory Outline’ আর কাজী আরেফ আহমেদ-এর সাপ্তাহিক তারকালোক পত্রিকায় ধারাবাহিক লেখা ও স্কোয়াড্রন লিডার আ্হসানউল্লাহ সম্পাদিত বাংগালী জাতি রাষ্ট্র লেখক কাজি আরেফ আহমেদ, আমি সিরাজুল আলম খান একটি জীবনালেখ্য, শামসুদ্দিন পেয়ারা সম্পাদিত, ও সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতা,-সশস্ত্র সংগ্রাম এবং আগামীর বাংলাদেশ তাজউদ্দীন কন্যা শারমীন আহমেদের নেতা ও পিতা বইগুলিতে বাংগালীর মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়েে যা বর্ননা করা হয়েছে তার সবটাই আজ মিথ্যা প্রমানিত করা যাবে না ।
নিউক্লিয়াস নেতা কাজি আরেফ আহমেদ বলেছিলেন “যে জাতি তার পূর্ব পুরুষের বীরত্বগাঁথা এবং ত্যাগের কথা জানে না; সে জাতির জাতীয়তাবোধ এবং দেশাত্মবোধ তিল মাত্র জন্মাতে পারে না। সে জাতি পৃথিবীতে কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। তাই আজ দেশের ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের উচিত নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনায় উদ্যোগী ভূমিকা রাখা। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ের নেতা ও সংগঠকদের উচিত সেই ইতিহাস রচনায় সহযোগিতা করা। আর স্বাধীনতা আন্দোলনে ও মুক্তিযুদ্ধে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের উচিত নিজেদের কৃতিত্ব উপস্থাপনের পাশাপাশি অন্যের অবদানকে খাটো বা অস্বীকার না করে নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনায় সচেষ্ট হওয়া।”
আপনার মতামত লিখুন :