যে পর্যবেক্ষণে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয় বিচারপতি সিনহাকে


প্রকাশের সময় : নভেম্বর ২, ২০২৪, ১২:০৫ পূর্বাহ্ন / ৫২
যে পর্যবেক্ষণে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয় বিচারপতি সিনহাকে

বিশেষ প্রতিনিধি 

২০১৭ সালে ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায় প্রদান নিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার সঙ্গে সরকারের চরম টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। তখন বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দল ও আইনজীবী সংগঠনগুলো দাবি করেন, সরকারের মনমতো রায় না দেওয়ায় বিচারপতি এসকে সিনহাকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। যার প্রমাণ পাওয়া যায় বিচারপতি সিনহার লেখা একটি বইতে। তিনি দাবি করেন, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার হুমকি ও ভীতি প্রদর্শনের মুখে তিনি দেশ ছেড়েছিলেন। কারণ রায়টি যেন সরকারের পক্ষে যায় সেজন্য তার উপর সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে চাপ তৈরি করা হয়েছিল। শুধু রায়টি সরকারের বিপক্ষে দেয়াই নয়, কিছু পর্যবেক্ষণ নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এমনকি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা বিচারপতি সিনহার রায়ের কঠোর সমালোচনা করেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারপতি সিনহা বলেন, ১৯৭১ সালে আমরা যে অলঙ্ঘনীয় ঐক্য গড়েছিলাম, তা শত্রুরা নস্যাৎ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। আজ আমরা একটি মুক্ত, স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে বাস করি। অথচ আজ ঔদ্ধত্য এবং অজ্ঞতাকে আমরা প্রশ্রয় দিয়ে চলছি। কোনো একজন ব্যক্তি দ্বারা কোনো একটি দেশ বা জাতি তৈরি হয়নি। আমরা যদি সত্যিই জাতির পিতার স্বপ্নে সোনার বাংলায় বাঁচতে চাই, তাহলে এই আমিত্বের আসক্তি এবং আত্মঘাতী উচ্চাভিলাষ থেকে আমাদের মুক্ত থাকতে হবে। এই আমিত্ব হলো কেবল এক ব্যক্তি বা একজন মানুষ সবকিছুই করতে পারেন এমন ভাবনা।

বিচারপতি সিনহা বলেন, আমরা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নগর–পরিকল্পনার দিকে তাকাই, তাহলে দেখি যেই ব্যক্তি তাদের নগরের পরিকল্পনা করেছেন, তাঁকেই তারা স্বীকৃতি দিয়েছে। দাসপ্রথা বিলুপ্তির জন্য আব্রাহাম লিংকনের স্ত্রী মেরি টড স্বীকৃতি পেয়েছেন। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আরও অনেকে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চারজন জেনারেলও রয়েছেন। কিন্তু আমাদের দেশে একটি রোগ আমাদের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। আর সেই রোগের নাম “অদূরদর্শী রাজনৈতিকীকরণ। এটা একটা ভাইরাস এবং দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সংস্কৃতিকে তা এমন বিস্তৃতভাবে সংক্রমিত করেছে যে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা এমন একটি ভবিষ্যৎ দেখতে বা কল্পনা করতেও পারছেন না যে ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পুরো জাতি, কোনো একজন ব্যক্তি নন।

রায়ে বিচারপতি সিনহা বলেন, এই বাজে রোগের কারণে নীতিনির্ধারকেরা সবকিছু ব্যক্তিকরণ করে ফেলেছেন। তাঁরা তাঁদের ক্ষুদ্র এবং সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে একটি ভুয়া ও “মেকি গণতন্ত্র” প্রতিষ্ঠা করেছেন। আর এটা তাঁরা লজ্জাজনকভাবে আমাদের সংবিধানের অন্যায্য সুবিধা নিয়ে করেছেন। অথচ ১৯৭১ সালে আমাদের শহীদেরা রক্ত দিয়ে এ সংবিধান লিখেছিলেন। আমাদের অবশ্যই এই নোংরা “আমাদের লোক” মতবাদ পরিহার করতে হবে। পরিত্যাগ করতে হবে এই আত্মঘাতী “আমি একাই সব” দৃষ্টিভঙ্গি। দলীয় আনুগত্য বা অর্থবিত্ত নয়, জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠান তৈরিতে শুধু মেধার বিবেচনাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।

এমন সব যুগান্তকারী পর্যবেক্ষণকে ভালো দৃষ্টিতে নেয়নি তৎকালীন সরকার। আপিল বিভাগের রায়ে দেশ একক কারও নেতৃত্বে স্বাধীন হয়নি বলে যে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে, সেটিতে ইতিহাস বিকৃতি হয়েছে বলে ওই সময় দাবি করেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এবং এটা অসদাচরণ কিংবা অন্য কিছু কি না, সেটা খতিয়ে দেখার অবকাশ আছে।
তিনি বলেন, এখানে বঙ্গবন্ধু শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি, তবে কোনো একক ব্যক্তির নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি বলে কথাটি আছে। ‘প্রথমত কথা হচ্ছে এই মামলায় এটা অপ্রাসঙ্গিক। দ্বিতীয়ত এটা ইতিহাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এবং ফাইনালি এটা ইতিহাস বিকৃত করার সমান।’

এই রায়ের পর ছয় বছর পর ২০২৩ সালে আওয়ামী লীগ সমর্থিত বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ বিচারপতি সিনহার পদত্যাগ চান। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে করেন বিক্ষোভ মিছিল। কড়া সমালোচনাও করা হয় সংসদে। পরে তাকে ছুটি নিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। গত বছর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, মনটা চায় ইস্তফা দিয়ে ফিরে আসি। যেখানে মুগুর দেয়ার সেটাও জানি। একজন চীফ জাস্টিসকেও নামিয়ে দিয়েছিলাম। তার এই বক্তব্য তখন দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়।

রায়ে বিচারপতি সিনহা বলেন, আমাদের সংবিধানের ভিত্তি হচ্ছে, “আমরা জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। জাতীয় সংসদ সংবিধানের পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না এবং কোনো আইন সংবিধানসম্মত কি না, তা বিচার করার অধিকার সংবিধান সুপ্রিম কোর্টকেই দিয়েছে।