আসলেই কি দুর্ভিক্ষ আসন্ন?


প্রকাশের সময় : নভেম্বর ৮, ২০২২, ৭:৫৮ পূর্বাহ্ন / ৩৭৪
আসলেই কি দুর্ভিক্ষ আসন্ন?

ফজলুর রহমান মুরাদ

বাংলাদেশের ফরেন কারেন্সির প্রধান উৎস রপ্তানি। কিন্তু রপ্তানির বাজার পশ্চিমা বাজারের উপর নির্ভরশীল। ইউরোপ বা আমেরিকায় মন্দার অর্থ হল ২০২৩ এ বাংলাদেশের রপ্তানির উপর সবথেকে বড় আঘাত আসতে যাচ্ছে। রপ্তানির পর ফরেন কারেন্সির বড় উৎস হল রেমিট্যান্স। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের রেমিট্যান্স এর প্রধান উৎস মধ্যপ্রাচ্য। জ্বালানির বাজারের নিয়ন্ত্রণ থাকায় মন্দায় সবথেকে লাভবান দেশগুলোও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ। অর্থনৈতিক ধাক্কা বিশ্বের সব অঞ্চলের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্যে কম পড়েছে বা পড়বে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই অঞ্চলথেকে রেমিট্যান্স এর উপর বড় প্রভাব পড়বার কথা ছিলনা। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত চলতি বছরেই রপ্তানি ও রেমিট্যান্স থেকেই সবথেকে বড় ধাক্কা এসেছে। প্রায় ২০ টি ব্যাংকের কাছে এলসি সেটেলমেন্টের জন্য পর্যাপ্ত ডলার নেই বলে বণিক বার্তায় রিপোর্ট এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ ধরে রাখার চেষ্টা করছে। যদিও এই সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং হাউজের $১.৩৫ বিলিয়ন ডলার বকেয়া পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ চলতি সপ্তাহেই রিজার্ভ কমে $৩৩ বিলিয়নে নামবে। আর যদি আইএমএফ এর পরামর্শে আন্তর্জাতিক স্টান্ডার্ড হিসাবে রিজার্ভ গননা হয় তবে রিজার্ভের পরিমাণ আরো $৮ বিলিয়ন কমবে। ধরে নেয়া যাক রিজার্ভ হবে $২৫ বিলিয়ন।

সম্প্রতি এলসি খোলার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ডলার বাঁচানো অথবা জ্বালানির দাম বৃদ্ধির জন্য পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন না করা বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ সল্পমেয়াদি সমাধান হিসাবে নেয়া হলেও এর বাস্তবিক প্রভাব অর্থনীতিতে কতটুকু নেতিবাচক বা ইতিবাচক সেটির এসেসমেন্ট জরুরি ছিল।

এলসির মাধ্যমে আমদানি না করতে পারলেও আন্ডার ইনভয়েসিং এবং হুন্ডির মাধ্যমে ব্যাবসায়ীরা আমদানি অব্যাহত রেখেছে। আর এখানেই প্রশ্ন উঠেছে যে নতুন করে ৯ লক্ষ জনশক্তি রপ্তানি হলেও রেমিট্যান্স কেন উলটা কমেছে? স্বাভাবিক বিষয় হল, এলসির কড়াকড়ি হুন্ডির দিকে বেশি আকৃষ্ট করেছে। ফলে রেমিট্যান্স হিসাবে ডলার আসার ক্ষেত্রে নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

দেশকেন্দ্রিক মুদ্রাস্ফীতির সমস্যার জন্য বাজারে অর্থের সরবরাহের তুলনায় পণ্য বা সেবার অপ্রতুলতাকে দায়ী করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে খুব সহজ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হচ্ছে ব্যাংক রেট বাড়িয়ে দিয়ে বাজার থেকে অর্থ তুলে নেয়া। কিন্তু সমস্যা যখন বৈশ্বিক তখন বিষয়টা এর সহজে সমাধান হয়না। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের ৬-৯ ক্যাপিং বর্তমান প্রেক্ষাপটে যৌক্তিকতা হারাচ্ছে এবং আইএমএফ ও সেটি পয়েন্ট আউট করেছে। আবার ক্যাপিং তুলে দিলেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে। ঋণ নেয়ার খরচ বৃদ্ধি পাবে।

মন্দার সময় আসলে কি হয় সে বিষয়টি পরিস্কার ধারনা থাকলে সমাধানটাও সহজ হয়। প্রথমত সারাবিশ্বে ব্যবসার ক্ষেত্রে মন্দার কারনে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। ফলে বাজার চাহিদা কমবে। এরকম সময়ে কোম্পানিগুলি চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদন কমাবে। নতুন বিনিয়োগ শ্লথ হয়ে আসবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন করে চিন্তা করবে।

গার্মেন্টস কোম্পানির ক্ষেত্রে একটা বড় রকমের প্রভাব পড়তে যাচ্ছে। সারাবিশ্বেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল খাতগুলি জায়ান্টদের দখলে যাচ্ছে। ভারতের ক্ষেত্রে গুটি কয়েক টেক্সটাইল জায়ান্ট যেভাবে বিনিয়োগ করেছে তাতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গেলে ক্ষুদ্র কারখানাগুলির জন্য চ্যালেঞ্জিং। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এদেশেও ক্ষুদ্র উৎপাদনকারীদের অনেকেই ব্যাবসা থেকে ছিটকে পড়বে। ট্রেডিং এর ক্ষেত্রেও ক্ষুদ্র আমদানি রপ্তানিকারকদের ব্যাবসায় টিকে থাকা কঠিন। বড় জায়ান্ট কোম্পানিগুলির পক্ষেই টিকে থাকা সম্ভব। আরেকটু বলতে গেলে আমাদের বর্তমান গ্রিনব্যাক নিয়ে যেরকম নীতি নেয়া হয়েছে তাতে মার্কেট মনোপলির দিকে যাবে। জায়ান্টরা বিশেষ সুবিধা পাবে তাদের ফিনানশিয়াল স্ট্রেন্থ এর জন্য।

দুর্ভিক্ষ যতটা প্রাকৃতিক তার থেকে বেশি মানবসৃষ্ট। যদি এমন হয় যে ২০২৩ এ বাংলাদেশে ২০০৭ এর মত ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে তাহলে আমরা ভয়ঙ্কর বিপদে পড়তে পারি। ২০২৩ এ খাদ্য নিশ্চিতে প্রতিটা দেশ সতর্ক থাকবে। এক্ষেত্রে নিজ দেশের উৎপাদন প্রাকৃতিক বা অন্য কারনে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সামাল দেয়া কঠিন হবে। এজন্য উচিত হবে ২০২৩ এ সার সরবরাহে যেন ঘাটতি না হয় আর উন্নত, উৎকৃষ্ট বীজ সরবরাহ যেন নিশ্চিত করা যায়। আগামীবছর খাদ্যের আন্তর্জাতিক বাজার স্থিতিশীল না থাকার ঝুঁকি রয়েছে। এক্ষেত্রে সার ও বীজ নিয়ে এখনি পরিকল্পনা প্রস্তুত রাখা জরুরি।

খাবারের পাশাপাশি আমাদের দরকার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গাড়ি আমদানি নিয়ন্ত্রণ, চলাচল নিয়ন্ত্রণে নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে। শিল্পে বিদ্যুৎ নিশ্চিতে কোন ক্রমেই হেলা করার সুযোগ নেই। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে করের ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া উচিত। সেই সাথে নিত্যপণ্যের অন্তত ৫-৬ টি আইটেমে সরকারি নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা জরুরি। সার, বিদ্যুৎ, জ্বালানির মত বেসিক বিষয়গুলি নিশ্চিত করে অন্যান্য আইটেমের ক্ষেত্রে আমদানি নিয়ন্ত্রন করা যেতে পারে। তবে বিলাস দ্রব্য বাদে অন্য আইটেমে বেশি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ঠিক হবেনা। কম্পিউটার বা আইটি আইটেমকে বিলাস দ্রব্য হিসাবে দেখানোর প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। না হলে ফ্রিল্যান্সিং উৎসাহিত করা যাবেনা।