“অগ্নি ঝরা মার্চ” ঝালকাঠি জেলার বধ্যভূমি ও গণকবর


প্রকাশের সময় : মার্চ ২৫, ২০২৪, ১২:৪৮ অপরাহ্ন / ১৫৮
“অগ্নি ঝরা মার্চ” ঝালকাঠি জেলার বধ্যভূমি ও গণকবর

আলমগীর শরীফ, ঝালকাঠি প্রতিনিধি-

মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে প্রথম স্বাধীনতার বীজ রুপিত হয়-সেই পথ ধরেই বাঙালি মরতে শিখেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতির সর্বোচ্চ ত্যাগে অর্জিত বিজয়-রক্তের রঙে আর সবুজ জমিনে মিশে উঠছে বিজয়ের পতাকা।

একাত্তরের চেতনা বাঙালি জাতির জীবনের হাজার বছরের ত্যাগ আর আত্মোৎসর্গের ফসল। সেই গৌরব আর স্বাধীন ভূখণ্ড একটি লাল সবুজ পতাকা অর্জনের জন্য বাঙ্গালীকে ঝরাতে হয়েছে অনেক রক্ত। এদেশের ৬৮ হাজার গ্রাম আর শত শত শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বর্বর পাকিস্তানিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের নীরব স্বাক্ষী শত শত বধ্যভূমি আর গণকবর। ঝালকাঠি জেলায় এরূপ ২২ থেকে ২৪ টি বধ্যভূমি ও একটি গণ কবরের সন্ধান এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে।

১. পৌর খেয়াঘাট বধ্যভূমি-ঝালকাঠি জেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি সুগন্ধা নদীর তীর ঘেসে তৈলের ডিপু থেকে পৌরসভা খেয়াঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় ২০০/২৫০ মিটার। এই বধ্যভূমিটি মূলত ঝালকাঠি শহর, ঝালকাঠি থানা ও এর আশেপাশে থেকে বর্বর পাকিস্তানরা নিয়মিত মানুষকে ধরে এনে টর্চার করার পর হত্যা করত। সুধা রাণী বসু (তৎকালীন প্রত্যক্ষদর্শী)’র বর্ণনা মতে এক মাসে অন্তত ১০০০ লোককে এখানে হত্যা করা হয়। ৩০ মে একদিনে অন্তত ১৬৫ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালীদের লাশ এখানে কখনো কখনো মাটিচাপা দেয়া হতো। অধিকাংশ লাশ সুগন্ধা নদীতে ভেসে যায়-কুকুর, শিয়াল শকুনেরা খায়। স্থানীয় যুবক হাসান মাহমুদ, পলাশ রায় প্রমুখের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় জেলা পরিষদের অর্থায়নে এখানে একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে।

২. পালবাড়ি খাদ্য গোডাউন ঘাট বধ্যভূমি-একাত্তরের নির্মম স্মৃতি বুকে ধারণ করে আছে বাসন্ডা খালের পূর্ব তীরের ঝালকাঠি সরকারী খাদ্য গোডাউন ঘাটের বধ্যভূমি। এখানে অন্তত একশ মুক্তিযোদ্ধা-বাঙালিকে হত্যা করে বর্বর নরপিশাচরা।

৩. শত দশকাঠি সতীলক্ষ্মী বালিকা বিদ্যালয় এর বধ্যভূমি- ঝালকাঠি শহরের উত্তর দিকে শত দশকাঠি গ্রামের এই বালিকা বিদ্যালয়ের বধ্যভূমিতে অন্তত অর্ধশত লোককে হত্যা করা হয়। এখানে ৩৮ জন শহীদের একটি তালিকা সংরক্ষিত আছে যারা সকলেই ওই এলাকার স্বাধীনতাকামী মানুষ ছিলেন।

৪. ডুমুরিয়া বধ্যভূমি-এই বধ্যভূমিতে শত শত হিন্দু নর-নারীকে হত্যা করে ডুমুরিয়া খালে সেই লাশ ভাসিয়ে দেয়া হতো। এখানে ডুমুরিয়া ইয়ুথ ক্লাবের উদ্যোগে নির্মিত ফলকে ১৭ জন শহীদের নাম উল্লেখ আছে।

৫. জগদীশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় বধ্যভূমি-এই বধ্যভূমিটি জগদীশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় এর পিছনে। এই স্কুলের সহকারী শিক্ষক কবি রবীন্দ্রনাথ মণ্ডলের বর্ণনামতে এখানে অন্তত তিনশত লোককে গ্রাম থেকে ধরে এনে নির্মম ভাবে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। বহুদিন ধরে পড়ে ছিল এই সব মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড়।

৬. নাপিত খালির ঠোডার বধ্যভূমি-নাপিতখালি আর বাসন্ডা খালের সংযোগস্থলের বধ্যভূমি। এখানে অন্তত ২০ জন লোককে ধরে এনে গুলি করে হত্যার পর লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।

৭. খাজুরা বধ্যভূমি-এখানে বহু মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে নির্মম ভাবে হত্যা করে পাক বাহিনী।
৮. ভিমরুলী বধ্যভূমি-কৃত্তিপাশা ইউনিয়নের ভীমরুলী স্কুলের উত্তর পাশে পেয়ারা বাগানে বহু লোককে পাক বাহিনী হত্যা করে লাশ পুঁতে রাখে, ফেলে রাখে এবং কুকুর, শকুন, শিয়ালে ব্যবচ্ছেদ করে।

৯. গাবখান বধ্যভূমি-গাবখান নদীর তীর ঘেঁষে গাবখান খেলার মাঠ। এই মাঠের দক্ষিণ পূর্বকোণ এবং গাবখান নদীর পাড়ে উভয় জায়গাটিতেই বহু লোককে হত্যা করা হয়। এখানে পাক আর্মিদের ক্যাম্প ছিল। স্থানীয় বাঙালি ছাড়াও গাবখান হাটে আসা হিন্দু মুসলিম মিলিয়ে ৫০ থেকে ২০০ লোককে (সঠিক পরিসংখ্যান নাই) পাক বাহিনী গুলি করে হত্যা করে।

১০. রমানাথপুর শরীফ বাড়ির বধ্যভূমি-ঝালকাঠি সদর থানার এই স্থানে একুশে মে শুক্রবার পাক বাহিনীর অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে মসজিদ থেকে বের করে গুলি করে হত্যা করে। পরে ২৩ মে পুনরায় শরীফ বাড়ির মসজিদে আক্রমণ করে এবং ১৭ জন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিকে মসজিদ থেকে বের করে এখানে হত্যা করে যাদের নাম ফলক সংরক্ষিত আছে।

১১. বেশাইন খান গ্রামের বধ্যভূমি-একাত্তরের ২৯ জুন বেশাইনখান গ্রামে যে সকল দামাল ছেলেদের পাকিস্তানিরা হত্যা করে তাদের স্মৃতিস্তম্ভ ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিফলক বেশাইনখান স্কুলের দক্ষিণ-পূর্ব কর্নারে সংরক্ষিত। এখানকার টকবগে যুবক মানিক নেতৃত্ব দিচ্ছিল তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের। মানিকের নাম অনুসারে এই স্থানের নাম মানিকনগর। এখানে নিহত ২৮ জন স্বাধীনতাকামী মানুষের একটি নামফলক সংরক্ষিত আছে।

১২. সাচিলাপুর বধ্যভূমি-গাবখান ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের সাচিলাপুর গ্রামের বিষখালী নদীর তীরে এই বধ্যভূমি। এখানে মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসীদেরকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয় পাক বাহিনী।

১৩. বেরমহল বধ্যভূমি-গাভা রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের বেরমহল হাট সংলগ্ন এই বধ্যভূমিতে ১৮ বৈশাখ একই দিনে অন্তত ৪০ জন লোককে হত্যা করা হয়।

১৪. খায়ের হাট মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন বধ্যভূমি-শেখেরহাট ইউনিয়নের খায়েরহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ওদের ক্যাম্প ছিল। বহু লোককে ধরে এনে এখানে অত্যাচার করতো। মুক্তিবাহিনীর তথ্য খুঁজতো- তারপর নদীর পাড়ে গুলি করে হত্যা করত।

১৫. বাগড়ি থানাঘাট বধ্যভূমি-একাত্তরের গণহত্যা ও নির্মম নির্যাতনের জীবন্ত সাক্ষী রাজাপুরের বাগড়ি থানাঘাট বধ্যভূমি। এখানে কয়েকশো লোককে হত্যা করা হয় যাদের লাশ নদীতে ফেলা হতো। বর্তমান লেখকের প্রচেষ্টায় ইউএনও আফরোজা বেগম পারুল এই বধ্যভূমিটি উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় জেলার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ভাবে সংরক্ষণ করেছেন।

১৬. রাজাপুর গোডাউন ঘাট বধ্যভূমি-থানাঘাটের অদূরেই গোডাউন ঘাট এ পাক বাহিনী বহু লোককে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিত তাদের লাশ।

১৭. নলছিটির তামাক পট্টি বধ্যভূমি-নলছিটি থানার থানা খাল সংযোগস্থলে সুগন্ধা নদীর তীরে তামাক পট্টিতে বহু লোককে হত্যা করে পাক-বাহিনী। ১৩ মে এক দিনেই নলছিটি বন্দরের অন্তত ১১ কিংবা ১৩ জন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীকে মিটিং এর কথা বলে থানায় ডেকে নিয়ে সন্ধ্যায় হত্যা করে এখানে।

১৮. মানপাশা বধ্যভুমি-মানপাশা বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোটখাল-আর এ খালের উপর নির্মিত পুল সে দিনের বর্বর নারকীয়তার স্বাক্ষী। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা সহযোগী, মুক্তিযুদ্ধকামী মানুষ ও নিরীহ নারী পুরুষ মিলিয়ে কয়েকশো লোককে হত্যা করা হয় এখানে।

১৯. বাঁশবুনিয়া দাসেরবাড়ি বধ্যভূমি-কাঁঠালিয়া উপজেলার সবচেয়ে বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়ে ছিল এখানে। এখানে একটি নাম ফলকে যাদের অনেকের নাম সংরক্ষিত আছে।
২০. আওড়াবুনিয়া বধ্যভূমি-নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষদের ধরে এনে আওড়াবুনিয়া হাই স্কুল মাঠে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করা হতো। গান বোর্ড থেকে গুলি করে এবং সেল নিক্ষেপ করেও এখানে অনেক লোককে হত্যা করা হয়।

২১. কুনহারি, আগলপাশা, বাসন্ডা প্রভৃতি স্থানে আরও বহু লোককে সে দিন হত্যা করা হয়ে ছিল। যাদের রক্তের বিনিময়ে আজকে আমরা স্বাধীন দেশের অধিবাসী।

২২. কাঠিপাড়া গনকবর-১৭ তারিখ পাকবাহিনী রাজাপুর উপজেলার শুক্তাগড় ইউনিয়নের কাঠিপাড়া গ্রামে রাজাকার আব্দুল খালেক মাস্টারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় একটি হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করে। এখানে একই সময়ে অন্তত ৫১ জন হিন্দু রমণী বিধবা হন। সে দিন একটি ঝোপের মধ্যে থেকে বের করে এনে রাজাকার ও পাক বাহিনী মিলে হত্যা করে নিরীহ বাঙালিদের। লাশ পরে ছিল ২ দিন। শিয়াল কুকুরে ব্যাবচ্ছেদ করেছে। পরে নিকটাত্মীয়রা যাদেরকে দুইটি গণকবরে পুঁতে রাখে। দুইটি গণকবরের একটি খুঁড়ে এ পর্যন্ত ১৬ জন মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়। যাদের একটি নাম ফলক লেখকের প্রচেষ্টায় এখানে সংরক্ষিত আছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এখানে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণাধীন রয়েছে।

এছাড়াও সারা বাংলাদেশের মতো ঝালকাঠি জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পাক বাহিনী নির্মম অত্যাচারের কাহিনী, হত্যাযজ্ঞ ও ধর্ষণ। যুদ্ধ-শিশুর অস্তিত্বও রয়েছে ঝালকাঠিতে। উল্লেখিত স্থান সমুহের কিছু কিছু স্থানে প্রতি বছর ২৫ মার্চ সন্ধ্যা রাতে বিগত কয়েক বছর যাবত কবি লেখক মুঃ আল আমীন বাকলাই, সাংবাদিক পলাশ রায়, সাংবাদিক আলমগীর শরীফ, সাংবাদিক আবু সায়েম আকন, সাংবাদিক রহিম রেজা, সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব আসলাম হোসেন মৃধা, বাউল ছালমা, সিরাজুল ইসলাম ও সাবিনা ইয়াসমিনসহ জেলা, উপজেলা পরিষদ ও প্রশাসনের কর্মকর্তার উপস্থিতিতে মোমবাতি জ্বালিয়ে বীর শহীদদের স্বরণ করা হয়। আজ সেই ২৫ মার্চ ২০২৪।